Bangladesh Unrest| Who is Dipu Chandra Das? বারুদের স্তূপে বাংলাদেশ! গাছে বেঁধে, মিথ্যে অভিযোগে জ্যান্ত জ্বালিয়ে দেওয়া হিন্দু যুবক দীপু দাস আসলে কে?

 Dipu Das murder in Bangladesh: দীপু হত্যার ঘটনাটি এমন এক সময়ে ঘটেছে যখন বাংলাদেশ জুড়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অত্যন্ত উত্তপ্ত। জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম মুখ এবং ‘ইনকিলাব মঞ্চ’-এর মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি গত বৃহস্পতিবার সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ঢাকায় মুখোশধারী দুষ্কৃতীদের গুলিতে আহত হয়েছিলেন তিনি। তাঁর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে বিক্ষোভ ও উত্তেজনা বিরাজ করছে।


ভারতবিদ্বেষী বিক্ষোভে উত্তাল বাংলাদেশ (Bangladesh Unrest)। সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে যখন স্থিতিশীলতা ফেরানোর চেষ্টা চলছে, ঠিক সেই মুহূর্তে ময়মনসিংহের (Mymensingh) ভালুকায় এক হিন্দু যুবককে পিটিয়ে ও পুড়িয়ে (Mob lynching in Bangladesh) মারার নৃশংস ঘটনা দেশজুড়ে তীব্র চাঞ্চল্য ও ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। নাম দীপুচাঁদ দাস (Dipu Chandra Das)। সূত্রের খবর, পেশায় কারখানার শ্রমিক ছিলেন তিনি। প্রথমে বেধড়ক মারধর ও পরবর্তীতে তাঁর গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয় উত্তেজিত জনতা। ওই যুবক ভালুকা উপজেলার দুবালিয়া পাড়া এলাকায় ভাড়াটে হিসেবে থাকতেন। পুলিস জানায়, স্থানীয়দের একটি দল তাকে মহম্মদ সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্য করার অভিযোগে রাত ৯টায় তাঁকে আক্রমণ করে। গত বৃহস্পতিবার রাতে ঘটে যাওয়া এই বর্বরতা কেবল একটি হত্যাকাণ্ড নয়, বরং এটি বর্তমান বাংলাদেশের (Bangladesh Violence) আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে গভীর প্রশ্নের উদ্রেক সৃষ্টি করেছে। ছাত্রনেতা শরিফ ওসমান হাদির (Osman Hadi) মৃত্যুকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া উত্তেজনার মধ্যেই এই ঘটনা ঘটেছে।


ঘটনার প্রেক্ষাপট ও নৃশংসতা

নিহত যুবক দীপু চন্দ্র দাস (২৫) ময়মনসিংহের ভালুকা এলাকায় ‘পাইওনিয়ার নিট কম্পোজিট ফ্যাক্টরি’তে পোশাক শ্রমিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। অভিযোগ ওঠে, দীপু ধর্ম অবমাননাকর মন্তব্য করেছেন। এই গুজবের ওপর ভিত্তি করে বৃহস্পতিবার রাত ৯টার দিকে একদল উন্মত্ত জনতা তাঁকে ঘিরে ধরে।


কারখানার নিরাপত্তার স্বার্থে কর্তৃপক্ষ তাঁকে বাইরে বের করে দিলে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যায়। উত্তেজিত জনতা তাঁকে বেধড়ক পিটিয়ে হত্যা করে। পাশবিকতার এখানেই শেষ নয়; হত্যার পর তাঁর নিথর দেহ একটি গাছের সঙ্গে বেঁধে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। সামাজিক মাধ্যমে এই ভয়াবহ দৃশ্যের ভিডিয়ো ছড়িয়ে পড়লে জনমনে আতঙ্ক ও ঘৃণার সৃষ্টি হয়।

তদন্তে উঠে আসা চাঞ্চল্যকর তথ্য

ঘটনা তদন্তে নেমে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব-১৪) এক অভাবনীয় তথ্য সামনে এনেছে। র‍্যাব কমান্ডার মোহাম্মদ সামসুজ্জামান জানিয়েছেন, দীপু চন্দ্র দাস সামাজিক মাধ্যমে বা প্রকাশ্যে কোনো উস্কানিমূলক কথা বলেছিলেন—এমন কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এমনকি ঘটনাস্থলে উপস্থিত জনতার কেউই নিজ কানে দীপুকে কিছু বলতে শোনেননি। মূলত ‘কারও মুখে শুনে’ বা গুজবের বশবর্তী হয়েই এই পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে। 

গ্রেফতার ও প্রশাসনের তৎপরতা

এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তিনি স্পষ্ট জানিয়েছেন, 'নতুন বাংলাদেশে হিংসার কোনও জায়গা নেই।' বর্তমানে এই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে মোট ১২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ভিডিয়ো ফুটেজ দেখে শনাক্ত করে র‍্যাব ও পুলিশ যৌথভাবে এই অভিযান চালায়। ধৃতদের মধ্যে আশিকুর রহমান, কাইয়ুম, লিমন সরকার ও তারেক হোসেনসহ আরও বেশ কয়েকজন রয়েছেন। ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নিরাপত্তা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। প্রশাসনের আশ্বাস সত্ত্বেও মানবাধিকার সংগঠনগুলির একাংশ নিরপেক্ষ ও দ্রুত তদন্তের দাবি তুলেছে

বাবার বর্ণনায় ভয়াবহ রাত

দীপুর মৃত্যুতে তাঁর পরিবার দিশেহারা। তাঁর বাবা রবিলাল দাস আক্ষেপ করে জানান, প্রতিবন্ধী বাবা-মা, স্ত্রী ও সন্তানের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন দীপু। সামাজিক মাধ্যমে ছেলের পোড়া দেহের ছবি দেখে তাঁরা খবর পান। সম্প্রতি যুব নেতা শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুর পর থেকেই পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। হাদি ছিলেন গত বছরের ছাত্র-নেতৃত্বাধীন জুলাই অভ্যুত্থান-এর অন্যতম মুখ এবং ইনকিলাব মঞ্চ-এর মুখপাত্র। জানা গিয়েছে, গত বৃহস্পতিবার সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় হাদির। ঢাকায় গত ১২ ডিসেম্বর মুখোশধারী দুষ্কৃতীদের ছোড়া গুলি মাথায় লাগলে গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পরে সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। তবে নিহতের বাবা রবিলাল দাস জানিয়েছেন, এখনও পর্যন্ত সরকার বা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পরিবারকে সরাসরি কোনও আশ্বাস দেওয়া হয়নি।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

এই ঘটনার প্রভাব পড়েছে সীমান্তের ওপারেও। ভারতের শিলিগুড়িতে মশাল মিছিল ও বিক্ষোভ হয়েছে। কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্র একে ‘মানবতার বিরুদ্ধে জঘন্য অপরাধ’ বলে অভিহিত করেছেন। এছাড়া অন্ধ্রপ্রদেশের উপ-মুখ্যমন্ত্রী পবন কল্যাণও এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন।

অস্থিরতার নেপথ্যে আরও কিছু কারণ

দীপু হত্যার ঘটনাটি এমন এক সময়ে ঘটেছে যখন বাংলাদেশ জুড়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অত্যন্ত উত্তপ্ত। জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম মুখ এবং ‘ইনকিলাব মঞ্চ’-এর মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি গত বৃহস্পতিবার সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ঢাকায় মুখোশধারী দুষ্কৃতীদের গুলিতে আহত হয়েছিলেন তিনি। তাঁর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে বিক্ষোভ ও উত্তেজনা বিরাজ করছে।

এরই মধ্যে বাংলাদেশে ভারত-বিদ্বেষী বিক্ষোভের জেরে রাজশাহী ও খুলনায় ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্র সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন ঘিরে নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে দিল্লি ইতিমধ্যেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য: 

ইউনূস বিবৃতিতে বলেছেন, ‘ময়মনসিংহের ভালুকায় দীপুচন্দ্র দাসকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় দশ জনকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাঁদের মধ্যে সাত জনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) এবং তিন জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।’ ধৃতদের নামও প্রকাশ করেছে প্রধান উপদেষ্টার দফতর। র‌্যাবের হাতে ধৃতেরা হলেন মহম্মদ লিমন সরকার, মহম্মদ তারেক হোসেন, মহম্মদ মানিক মিয়া, এরশাদ আলি, নিজুম উদ্দীন, আলমগির হোসেন এবং মহম্মদ মিরাজ হোসেন আকন। পুলিশের হাতে ধৃতদের নাম মহম্মদ আজমল হাসান সগীর, শাহিন মিয়া এবং মহম্মদ নাজমুল। ময়মনসিংহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল্লা আল মামুন জানিয়েছেন, ধৃত ১০ জনকে ভালুকা থানায় পাঠানো হয়েছে। সেখানে তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

তসলিমা নাসরিনের বক্তব্য: 

নির্বাসিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন অভিযোগ করেছেন, এক মুসলিম সহকর্মীর সঙ্গে তুচ্ছ বিবাদ থেকে দীপুকে মিথ্যে অভিযোগে ফাঁসানো হয়েছিল। দীপু চন্দ্র দাসকে মিথ্যা ধর্ম অবমাননার অভিযোগে ফাঁসানো হয়েছিল। এক্স-এ করা পোস্টে তিনি দাবি করেন, এক মুসলিম সহকর্মীর সঙ্গে তুচ্ছ বিবাদ থেকেই দীপুর বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়।তসলিমা নাসরিন আরও বলেন, দীপু ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাঁর উপার্জনের উপর নির্ভর করতেন প্রতিবন্ধী বাবা-মা, স্ত্রী ও সন্তান।

নিন্দার ঝড়

ঘটনাটির তীব্র নিন্দা করেছেন ভারতের কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী বঢরা। তিনি একে “মানবতার বিরুদ্ধে জঘন্য অপরাধ” বলে অভিহিত করেন। অন্ধ্রপ্রদেশের উপ-মুখ্যমন্ত্রী পবন কল্যাণও এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকার কথা স্মরণ করিয়ে দেন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ও ভারতের রাজনৈতিক ও মানবাধিকার মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে।

ময়মনসিংহের এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, গুজব এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি একটি সমাজকে কতটা অন্ধ করে দিতে পারে। সরকার অপরাধীদের গ্রেফতার করলেও, জনমনে স্বস্তি ফেরাতে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করা এখন প্রশাসনের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। দীপু চন্দ্র দাসের পরিবার এখন কেবল বিচারের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। অশান্ত বাংলাদেশে কী হয়, তা এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।

ভারতের প্রতিক্রিয়া:

বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে অবশেষে মুখ খুলল ভারত। বাংলাদেশ নিয়ে প্রথম প্রতিক্রিয়ায় দীপুর হত্যাকারীদের বিচারের দাবি জানাল ভারত। ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল একটি বিবৃতিতে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের পরিস্থিতির দিকে নিবিড় ভাবে নজর রেখেছে ভারত। সে দেশের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমাদের আধিকারিকেরা যোগাযোগ রাখছেন। সংখ্যালঘুদের উপর হামলা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন— তা তাঁদের জানানো হয়েছে। দীপুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডে অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। ভারত সেই আবেদন জানিয়েছে।’


Post a Comment

Previous Post Next Post