Explained: তাইওয়ান দখলে তৈরি চিন! আরও একটা প্রাণঘাতী যুদ্ধ?
আরেকটা যুদ্ধ কি আসন্ন? তাইওয়ান দখল করবে চিন? গত ১৪ মাস ধরে প্রেসিডেন্ট লাই চিং-এর শাসনকালে চিনা সেনা লাগাতার সেনা, নৌ-মহড়া, গুলি ও মিসাইল পরীক্ষা করে চলেছে তাইওয়ান সীমান্তে। যে কোনও মুহূর্তে আগ্রাসন দেখতে পারে লালফৌজ। ধরে নিয়েই এগোচ্ছে তাইওয়ান। বাড়ানো হচ্ছে ড্রোন উৎপাদন।

"তাইওয়ান দখলের প্রস্তুতি নিচ্ছে চিন” স্কাই নিউজকে দেওয়া এক বিস্ফোরক সাক্ষাৎকারে এই দাবি তুলে শোরগোল ফেলে দিয়েছেন তাইওয়ানের উপবিদেশমন্ত্রী য়ু চিহচাং। এমনিতেই গত বেশ কয়েকমাস ধরেই লালফৌজ তাইওয়ান সীমান্তে শক্তি বাড়াচ্ছে, এবার তার মধ্যেই খোদ দেশের উপবিদেশমন্ত্রীর এই বক্তব্যে আন্তর্জাতিক মহলে তোলপাড় পড়ে গেছে। চিনা আগ্রাসনের সামনে কার্যত আত্মসমপর্ণ ছাড়া আর কোনও উপায় দেখতে পাচ্ছে না তাইপেই। য়ু চিহচাং জানান, আমেরিকার সাহায্য ছাড়া চিনকে আটকানোর আর কোনও বাস্তব উপায় তাঁদের সামনে নেই।
চলতি বছরের শুরু থেকেই তাইওয়ান সীমান্তের কাছে চিনা সেনার গতিবিধি বেড়েছে। এমনকী চিনের পিপলস লিবারেশন আর্মি বা PLA ঘোষণাও করে দেয়, ‘এক চিন কোনও স্বপ্ন নয়, এমন এক বাস্তব যা দ্রুতই হাসিল হবে।’ তাইওয়ান সীমান্তের কান ঘেঁষে একের পর চিনা রকেট, মিসাইল ও ড্রোন উড়িয়ে পরোক্ষে তাইওয়ান সরকারকে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়। চিনা ইস্টার্ন থিয়েটার কমান্ড ও চিনা উপকূলরক্ষী বাহিনীর মহড়ায় অন্তত ৭১টি যুদ্ধবিমান ও ১৯টি যুদ্ধজাহাজ অংশগ্রহণ করে। তাইওয়ান সরকার অভিযোগ করে, বিনা প্ররোচনায় বারবার তাইওয়ান সীমান্তে অনুপ্রবেশ করছে চিনা সেনা। ১০টি চিনা রণতরী তাইওয়ান সীমান্তের ৪৪ কিলোমিটারের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে বলে আন্তর্জাতিক মহলে অভিযোগ জানায় তাইওয়ান। পাল্টা তাইওয়ানও সীমান্তে সেনা মোতায়েন বাড়ায়।
পরিস্থিতি এমন জায়গায় দাঁড়িয়ে যে তাইওয়ানের মৎস্যজীবীদের নৌকা পর্যন্ত পূবে হাওলিন উপকূলে মাছ ধরতে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না। চিনা কোস্টগার্ডের নৌকা সীমান্ত বরাবর কড়া নজরদারি চালাচ্ছে। আন্তর্জাতিক নজরদারি এড়াতে নৌকাগুলির গায়ে নাকি কোনও দেশের পতাকা বা চিহ্ন পর্যন্ত নেই। কিন্তু সেই নৌকায় নিরাপত্তারক্ষীদের হাতে যে অস্ত্র রয়েছে সেগুলি দেখলেই বোঝা যাচ্ছে তাঁরা চিনা কোস্ট গার্ডের সদস্য। ওরকম আধুনিক জাহাজ বা অস্ত্রশস্ত্র অন্য কারও নেই, বলছেন তাইওয়ানের মৎস্যজীবীরা। সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আসলে এসব স্নায়ুর লড়াই। তাইপেইয়ের মনে ভয় ধরাতে চাইছে বেজিং। এই কারণেই তাইওয়ানের নয়া প্রেসিডেন্ট লাই চিং-র বর্ষপূর্তিতে চিনা নৌবহরের প্রায় ৩০টি জাহাজ তাইওয়ান সীমান্ত অতিক্রম করে এপারে চলে আসে। পরে অবশ্য লালচিন বিবৃতি দেয়, ‘যা হয়েছে ভুল করে হয়েছে’।
এই পরিস্থিতিতে তাইওয়ান তাকিয়ে রয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দিকে। কিন্তু ট্রাম্প দ্বিতীয়বার হোয়াইট হাউসে বসার পর থেকেই তাইওয়ানের উপর ক্ষুব্ধ। তাঁর অভিযোগ, মার্কিন সেমি-কন্ডাক্টরের বাজার ‘চুরি’ করছে তাইওয়ান। রেগে গিয়ে তাইওয়ানের উপর ৩২% শুল্ক চাপানোর হুমকি দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, তাইওয়ানকে প্রতিরক্ষার জন্য অস্ত্র দেবেন কি না সেটাও ভেবে দেখবেন বলে শুনিয়ে রেখেছেন। তাই ট্রাম্পের উপরেও ভরসা করতে পারছে না তাইওয়ান। তবে তাইওয়ান প্রণালীতে যে কোনও সংঘাত বিশ্ব বাণিজ্য এবং আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতার উপরে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ, আমেরিকা-সহ বিশ্বের বহু দেশেই উন্নত মানের সেমিকন্ডাক্টর চিপ সরবরাহে তাইওয়ানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
এমনিতে তাইওয়ানকে আলাদা রাষ্ট্রের মর্যাদা দেয়না চিন। তবে চিনা চোখরাঙানি উপেক্ষা করে তাইয়ানের নিজস্ব সেনা, মুদ্রা ও সরকার রয়েছে। তাইওয়ানের মানুষও চিনা আধিপত্যবাদ মেনে নিতে রাজি নন। তবে সে সবে কান দিতে নারাজ শি সরকার। দরকার পড়লে ছোট্ট দ্বীপটিকে মিসাইল দেগে উড়িয়ে দেওয়ারও হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছে পিএলএ। তাইওয়ানের প্রেসিডেন্টকেও গুরুত্ব দিতে নারাজ লালপার্টি চিনা সোশ্যাল মিডিয়া তাঁর কার্টুনে ভরিয়ে রেখেছে। চলছে ‘এক চিন’-এর পক্ষে উগ্র জাতীয়তাবাদী প্রচার। যা দেখেশুনে তাইপেই-এর আশঙ্কা, সরাসরি আক্রমণ না করে তাইওয়ানকে ঘিরে ফেলে, ‘ব্লকেড’ করেও রাখতে পারে চিন।
এত সব কিছুর পরেও তাইওয়ান সরকার ট্রাম্পের মুখাপেক্ষী হয়েই রয়েছে। ট্রাম্প শুল্ক চাপানোর হুমকি দিলেও প্রেসিডেন্ট লাই একে ‘দুই বন্ধুর মধ্যে সাময়িক ভুল বোঝাবুঝি’ বলে মিডিয়াতে ব্যাখ্যা করেছেন। তাইওয়ান, এমনকী গোটা বিশ্বের অন্যতম বড় সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদনকারী সংস্থা TSMC সম্প্রতি আমেরিকাতে নয়া কারখানায় ১০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে সম্মত হয়েছে। আজকের দিনে মোবাইল, কম্পিউটার -সহ প্রায় সব বৈদ্যুতিন যন্ত্রেই সেমিকন্ডাক্টর চিপ দরকার। দুনিয়ার মোট চিপের ৯০% তৈরি হয় তাইওয়ানে-ই। এটাই একমাত্র কারণ আমেরিকা ও তার বন্ধুরা চিনা আগ্রাসনের হাত থেকে তাইওয়ানকে বাঁচাতে পারে। এছাড়াও তাইওয়ান প্রণালী একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক জলপথ, যার মধ্য দিয়ে প্রতি বছর কয়েক ট্রিলিয়ন ডলারের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য হয়।
তবে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ খানিকটা সাহস জোগাচ্ছে তাইওয়ানকে। রাশিয়ার মতো মহাশক্তিধর দেশের সামনে ইউক্রেন যদি বছরের পর বছর লড়াই চালিয়ে যেতে পারে, তাহলে তাইপেই কেন পারবে না? একথা মাথায় রেখেই দেরিতে হলেও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে মজবুত করে জোর দিয়েছে তাইপেই। আমেরিকার কাছ থেকে আমদানি ছাড়াও দেশীয় প্রযুক্তিতে অস্ত্র তৈরিতে জোর দিচ্ছে তাইওয়ান। ইউক্রেনকে দেখে ড্রোন উৎপাদনে বাড়তি নজর দেওয়া হয়েছে। ২০২৮-এর মধ্যে ১,৮০,০০০ ড্রোন বানাতে চায় ছোট্ট দেশটি। তবে চিনা অস্ত্র ভাণ্ডারের কাছে এই সংখ্যাটা কিছুই নয়। চিন অবশ্য আরও একটা কথা জানিয়ে রেখেছে। তাইওয়ান ইস্যু চিনের অভ্যন্তরীণ ইস্যু। এই নিয়ে তারা কারও কথা, উপদেশ শুনবে না। এমনকী চিন তো তাইওয়ানের সরকারের অস্তিত্ব মানতেও নারাজ। সব দেখেশুনে আন্তর্জাতিক মহলে এখন প্রশ্ন, ৮০ বছরের নিরাপদ আশ্রয়ে থাকার পর এবার কি তাইওয়ানের মানুষকে চিনের কাছে পরাধীন হয়ে বাঁচতে হবে?